Tuesday 16 May 2017


রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুচেতনা (মাম্পি বিশ্বাস . রোল 23)


যেদিন কবি জগৎকে অনুভব করলেন, সেদিন বিধাতার সঙ্গে তাঁর নিবিড় সম্পর্ক গড়ে উঠল। পাখির গান আর নদীর প্রবাহ সংগীতময়। ফুল সুগন্ধময়। গাছ, নদী, মেঘ সব মিলে নয়নাভিরাম দৃশ্য। দখিনা বাতাসের স্পর্শ কত মধুর। এর সঙ্গে আছে প্রিয়জনের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক আর তাদের মধ্য দিয়ে বিধাতার সঙ্গে সম্পর্কের গভীরতা।

কিন্তু তিনি পাঠকদের মনে করে দিয়েছেন এই বলে যে তাঁরা নিশ্চয়ই তাঁর লেখায় তাঁর মৃত্যুচেতনা লক্ষ করেছেন। ‘জন্মিলে মরিতে হবে’- এ কথা আমরা সবাই জানি। কিন্তু এ কথার উপলব্ধি অত্যন্ত গভীর ও জটিল। অনন্তকাল ধরে মানুষ জন্মেছে আবার চলেও গেছে। মৃত্যু তবু চির অজানা। চির অচেনা। তাই চির রহস্যময়। এসব কারণে ভীতিপ্রদও বটে। তাই মৃত্যু নিয়ে হয়েছে কত কাব্য রচনা। কত দর্শনের কত তত্ত্ব রচনা। কত ধর্মের কত নিবিড় কথা। কিন্তু কেউ আশ্বস্ত হতে পেরেছে কি তবু প্রশ্ন থেকে যায়, জীবনটা তবে কী কোনো বৈজ্ঞানিক এ প্রশ্নের উত্তর দিতে আজও পারেননি। যখন একটা জীবিত মানুষ মৃত ঘোষিত হয়, তখন কোন জিনিসটা তাকে ছেড়ে চলে যায় অণু-পরমাণুর তত্ত্ব দিয়ে তা ব্যাখ্যা করা যায়নি। কোথায় কার কাছে তা চলে যায় পরকালটা কোথায় নক্ষত্র আর চন্দ্র-সূর্যের মাঝখানে কোথায় মানুষ চলে যাবে মরণের পর আত্মা কী আত্মা অবিনশ্বর বলেন বিজ্ঞজনেরা। আত্মা কি ইন্দ্রিয়গ্রাহ্যতার অতীত এটা কি নিছক তত্ত্বকথা এই পৃথিবীটা যদি ক্ষণিকের হয়, তবে পরকালের আবাসভূমি কেমন, সে কথা তো দেখে এসে আমাদের বলেননি কেউ। আত্মার ইন্দ্রিয়গ্রাহ্যতার অভাবের কারণেই কি পরকাল সম্পর্কে অনেক প্রশ্ন থেকে যায় এ কারণেই কি মৃত্যু রহস্যময় থেকে যায়

পরকালে যাওয়াটা যদি হবে আমাদের স্থায়ী ঠিকানা, সেখানে যাওয়াই যদি হবে বিধাতার সান্নিধ্যে যাওয়া, তবে প্রস্তুতিটা কেন সুখকর নয় এই অভিজ্ঞতা কি পৃথিবীর মায়া কাটাবার জন্য উদ্দেশ্যটা মহৎ হলেও পš’াটি খুব একটা সহৃদয় নয়। বুদ্ধদেব বসু ‘রবীন্দ্রনাথের শেষজীবন’ বর্ণনা করেছেন। ‘কঠিন রোগসঙ্কটের ছায়ায় দেশব্যাপী জয়ধ্বনির মধ্যে রবীন্দ্রনাথের আশি বছর পুরলো।’ বুদ্ধদেব বসু আরো লিখেছেন, ‘মুখ তাঁর শীর্ণ, আগুনের মতো গায়ের রং ফিকে হয়েছে, কিন্তু হাতের মুঠি কি কব্জির দিকে তাকালে বিরাট বলিষ্ঠ দেহের আভা সেখানে পাওয়া যায়। কেশরের মতো যে কেশগুচ্ছ তাঁর ঘাড় বেয়ে নামত, তা ছেঁটে ফেলা হয়েছে। মনে হলো তাঁর চোখের সেই মর্মভেদী তীক্ষ্ন ভাবটা আর নেই।’

বুদ্ধদেব বসুর বর্ণনা বড্ডই মর্মস্পর্শী। ‘রবীন্দ্রজীবনের এই অধ্যায় মহাকাব্যের উপাদান। মনে করা যাক দিগ্বিজয়ী একজন রাজা, ঐশ্বর্যের সর্বাঙ্গীণ পূর্ণতায় যাঁর জীবন কেটেছে, একদিন ভাগ্যের কুটিলতায় তাঁকে রিক্ত হতে হলো। রাজত্ব রইল, রইল অন্তরের রাজকীয়তা, কিন্তু যেসব পথ দিয়ে রাজার সঙ্গে রাজত্বের যোগাযোগ, সেগুলো বন্ধ হয়ে গেল। রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টিপ্রেরণা অক্ষুণœ, অক্লান্ত তাঁর প্রতিভার উদ্যম কিন্তু দেহের যে সামান্য কয়েকটা যন্ত্রের সাহায্য ছাড়া শিল্পরূপ প্রকাশিত হতে পারে না, তারা ঘোষণা করেছে অসহযোগ। তাঁর ইন্দ্রিয়ের দরজাগুলো একে একে বন্ধ হয়ে আসছে। দৃষ্টিশক্তি ক্ষীণ, শ্রবণশক্তি নিস্তেজ, আঙুল দুর্বল, তুলি ধরবার মতো জোর নেই, কলমও কেঁপে যায়।’ তিনি নাকি বলেন, ‘বিধাতা মুক্তহস্তেই দিয়েছিলেন, এবার একে একে ফিরিয়ে নিচ্ছেন।’

মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি বা কোনো বিষয়ে মনোভাব গড়ে ওঠার কারণ থাকে। এই সম্ভাব্য কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে মানুষের অভিজ্ঞতা ও পরিবেশ। জীবনস্মৃতি গ্রšে’র ‘মৃত্যুশোক’ প্রবন্ধে প্রিয়জন হারানোর বেদনা ব্যক্ত করেছেন রবীন্দ্রনাথ। তিনি লিখেছেন যে তাঁর মায়ের যখন মৃত্যু হয়, তখন তাঁর বয়স অল্প, মায়ের যখন মৃত্যু হয়, তখন তিনি ঘুমাচ্ছিলেন। পরদিন সকালে যখন তিনি মৃত্যুসংবাদ শোনেন তখন তিনি ‘সে কথাটার অর্থ সম্পূর্ণ গ্রহণ করতে পারেননি।’ তিনি দেখেছিলেন মায়ের দেহ, সুসজ্জিত দেহ খাটের ওপর শোয়ানো। ‘জীবন থেকে জীবনান্তের বিচ্ছেদ স্পষ্ট করে তাঁর চোখে পড়েনি।’ তিনি লিখেছেন, ‘যে ক্ষতি পূরণ হইবে না, যে বিচ্ছেদের প্রতিকার নাই, তাহাকে ভুলিবার শক্তি প্রাণশক্তির একটি প্রধান অঙ্গ, শিশুকালে সেই প্রাণশক্তি নবীন ও প্রবল থাকে, তখন সে কোনো আঘাতকে গভীরভাবে গ্রহণ করে না, স্থায়ী রেখায় আঁকিয়া রাখে না।’ কিন্তু তাঁর ২৪ বছরের সময় ‘মৃত্যুর সঙ্গে যে পরিচয় হইল, তাহা স্থায়ী পরিচয়।’ তিনি লিখলেন, ‘অধিক বয়সে মৃত্যুকে অত সহজে ফাঁকি দিয়া এড়াইয়া চলিবার পথ নাই।’ এই মৃত্যুর মধ্য দিয়ে প্রথমবারের মতো একটা শূন্যতা অনুভব করলেন। ‘যাহা আছে এবং যাহা রহিল না, এই উভয়ের মধ্যে কোনোমতে মিল করিব কেমন করিয়া!’ তিনি লিখলেন, ‘শূন্যতাকে মানুষ কোনোমতেই অন্তরের সঙ্গে বিশ্বাস করতে পারে না। যাহা নাই, তাহাই মিথ্যা, যাহা মিথ্যা তাহা নাই।’

কবিগুরু এরপর একটা অপূর্ব অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ করেছেন। আমি প্রায় ২৫ বছর প্রবীণদের মানসিক সমস্যার চিকিৎসা করেছি। অনেক শোকার্ত মানুষের গভীর উপলব্ধি হৃদয় দিয়ে শুনেছি। কিন্তু এমনটি শুনিনি। মানুষের অনুভূতি একান্তই ব্যক্তিগত। কবিগুরু লিখেছেন, ‘তবু এই দুঃসহ দুঃখের ভিতর দিয়া আমার মনের মধ্যে ক্ষণে ক্ষণে একটা আকস্মিক আনন্দের হাওয়া বহিতে লাগিল, তাহাতে আমি নিজেই আশ্চর্য হইতাম।’ এই অপূর্ব অভিজ্ঞতার ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছেন তিনি, ‘যাহাকে ধরিয়াছিলাম, তাহাকে ছাড়িতেই হইল, এইটাকে ক্ষতির দিক দিয়া দেখিয়া যেমন বেদনা পাইলাম, তেমনি সেই ক্ষণেই ইহাকে মুক্তির দিক দিয়া দেখিয়া একটা উদার শান্তি বোধ করিতাম।’ মৃত্যুর এই অভিজ্ঞতায় ‘বৈরাগ্যের ভিতর দিয়া প্রকৃতির সৌন্দর্য আরো গভীরভাবে রমণীয় হইয়া উঠিয়াছিল।’

সৈয়দ মুজতবা আলি তাঁর ‘বড়বাবু’ গ্রšে’ ‘মৃত্যু’ নামে একটি হৃদয়গ্রাহী প্রবন্ধ লিখেছেন। তিনি বর্ণনা করেছেন কিভাবে রবীন্দ্রনাথ একে একে অতি আপনজন হারিয়েছেন। প্রাণাধিকা বৌদিকে হারানোর পর বড়ভাই গত হলেন, পিতা গত হলেন। স্ত্রী মৃণালিনী দেবী মারা গেলেন প্রায় ৩০ বছর বয়সে যখন কবির বয়স ৪১। এরপর মারা গেলেন দ্বিতীয়া কন্যা রেণুকা। বছর চারেক পরেই কলেরায় মারা গেলেন পুত্র শমিন্দ্রনাথ ১৩ বছর বয়সে। এর প্রায় বছর দশেক পরে মৃত্যুমুখে পতিত হলেন বড় মেয়ে মাধুরীলতা। ৭১ বছর বয়সে কবি হারালেন তাঁর স্নেহের নাতি বিদেশে অধ্যয়নরত নীতুকে।

কবি একদিন মৈত্রেয়ী দেবীকে বলেছিলেন, ‘তোমরা যাকে ভালোবাসা বল, সে রকম করে আমি কাউকে কোনোদিন ভালোবাসিনি। বন্ধু-বান্ধব, সংসার, স্ত্রী-পুত্র কোনো কিছুই আমি তেমন করে আঁকড়ে ধরিনি। ভেতরে একটা জায়গায় আমি নির্মম, তাই আজ যে জায়গায় এসেছি, সেখানে আসা আমার সম্ভব হয়েছে। তা যদি না হতো, যদি জড়িয়ে পড়তুম তা হলে আমার সব নষ্ট হয়ে যেত।’ লেখক হিরন্ময় ভট্টাচার্যের মন্তব্য, ‘সাধারণ মানুষের ভালোবাসা এবং তাঁর ভালোবাসার মধ্যে পার্থক্য এই যে তারা ভেঙে পড়ে, তিনি অসীম শক্তি দিয়ে নিজেকে সংযত রাখতেন।’ 

No comments:

Post a Comment